নিউজ ডেস্ক :মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ১নং ফেরি ঘাট। এই ঘাটটি মূলত ভিআইপি ফেরিঘাট নামে পরিচিত। এই ঘাটে আইসিইউ সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্সে ফেরির জন্য অপেক্ষা করছিল সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এক স্কুলছাত্র। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফেরিতে ওঠে অ্যাম্বুলেন্সটি। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণে মাঝ নদীতে থাকা অ্যাম্বুলেন্সেই তার মৃত্যু হয়।
নিহত ওই স্কুলছাত্রের নাম তিতাস ঘোষ (১১)। সে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পৌর এলাকার মৃত তাপস ঘোষের ছেলে এবং কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ট শ্রেণির ছাত্র।
বিআইডব্লিউটিসি কাঁঠালবাড়ি ঘাট সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে মাদারীপুরের কাঠালবাড়ি ১নং ফেরিঘাটে পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্স। তখন ‘কুমিল্লা’ নামের ফেরিটি ওই ঘাটেই ছিল। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা তিতাসের স্বজনরা ঘাটের কর্মকর্তাদের ফেরি ছাড়তে অনুরোধ জানান। ঠিক ওই সময়ই মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ঘাট কর্তৃপক্ষকে একটি জরুরী বার্তা পাঠান।
সেখানে বলা হয়, সরকারি একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ফেরি করে পদ্মা পাড়ি দেবেন। তাই ঘাটে থাকা ফেরিটি যেন আগে ছেড়ে না যায়। তাই ঘাট কর্তৃপক্ষ ওই কর্মকর্তার গাড়ি না আসা পর্যন্ত ফেরি ছাড়তে রাজি হয়নি।
এদিকে স্বজনদের অভিযোগ, ভিআইপি আসার অপেক্ষায় প্রায় ৩ ঘণ্টা ঘাটেই বসে ছিল ফেরি। আশপাশের লোকজনের অনুরোধের পরও কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে ফেরি ছাড়েনি। এমনকি সরকারি জরুরী সেবা পেতে ৯৯৯ নম্বর ফোন করেও মেলেনি প্রতিকার।
জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম মুঠোফোন বলেন, সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আব্দুল সবুর মণ্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। তিনি কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়ার আগে আমার কাছে ফেরিতে যাওয়ার বিষয়টি জানান। পরে আমি ঘাটের ব্যবস্থাপক সালামকে ভিআইপি ফেরিতে ওঠার বিষয়ে বার্তা পাঠাই। কিন্তু ওই ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে একজন গুরুতর আহত অবস্থায় রোগী আছেন তা আমি জানতাম না। আমাকে ঘাটের ম্যানেজার এ বিষয়ে কিছুই জানাননি। আজই বিষয়টি জানতে পারলাম।
সরকারি কর্মকর্তা বা ভিআইপিদের জন্য ফেরি আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকার কোন নিয়ম রয়েছে কিনা জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, তিনি চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক। এছাড়াও তিনি যুগ্ম সচিব। তাই তাকে ভিআইপি বলা যায়। এই ধরনের কর্মকর্তারা নৌপথে এলে তাদের বিশেষভাবে গুরুত্ব আগে থেকেই দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয় বিআইডব্লিউটিসি কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক মো. সালাম হোসেন মিয়া বলেন, ডিসি স্যার ফোন দিয়ে রাতে জানান ভিআইপি যাবে। তবে আমি তখন ঘাটে ছিলাম না। আমাদের স্টাফকে বলে দেই ভিআইপি আসার কথা। পরে সেখানে কি হয় তা আমার জানা নেই।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে পদ্মা নদীতে স্রোত বেশি থাকায় ফেরি পারাপারে দ্বিগুণ সময় লাগে। এছাড়াও রাতে তেমন একটা ফেরি চলে না। তাই ঘাটে যানজট কমবেশি থাকেই। তবে আমরা অ্যাম্বুলেন্সসহ সাধারণ যাত্রীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপারের ব্যবস্থা করে দেই।
নিহত তিতাসের স্বজনরা জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ায় প্রথমে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসক। চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রেখে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে অর্ধলাখ টাকায় ভাড়া করা হয় আইসিইউ সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্সটি। অ্যাম্বুলেন্সটি ঘাটে এসে থামে রাত ৮টার দিকে।
এসময় তিতাসের স্বজনরা ঘাটে ফেরি পারাপারের জন্য সাহায্য চান ঘাট কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে। তিন ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকার পর রাত পৌনে ১১টার দিকে সাদা রঙের নোয়া মাইক্রোবাসটি ফেরিতে ওঠার পরে ছাড়া হয়। ফেরি ছাড়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই মাঝ নদীতে মারা যায় তিতাস।
তিতাসের বড় বোন তন্নীসা ঘোষ বলেন, আমার ভাইয়ের জীবন কেড়ে নিল ভিআইপি। এ দেশে জীবনের দাম বেশি না ভিআইপিদের দাম বেশি?
তিতাসের মা সোনামনি ঘোষ কান্না করতে করতে বলেন, ‘বাবা তোমাগো কাছে বললে কি আমার পোলারে পামু? ওরা আমার পোলারে মেরে ফেলছে? আমি ফেরি আলাগো পায় ধরছি, তবুও ওরা ছারে নাই। ফেরি ঠিক মতন গেলে হয়তো পোলাডা বাইচা জাইতো।’